১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা কর।

অথবা, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলমান আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলন বলা হ্যা। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচন অনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু ভুট্টো চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগকে পাস কাটিয়ে সরকার গঠন করতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার ভিত্তিতে সরকার গঠনে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ হঠাৎ করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে।

অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি: পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সময বিভিন্ন অজুহাতে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করে। প্রতিবাদী বাঙালি জাতি বৈষম্য ও দমনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা সুদৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ হয়। ‘৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকরলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে কালক্ষেপণ শুরু করে। পূর্ব বাংলা সংগ্রামী জনতা এর বিরুদ্ধে দাবি আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। নিচে তা বর্ণনা করা হলো:

১. ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়: ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ৩১৩ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি (মহিলা ৭টি সহ) আসন লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যদিকে জাতীয় পরিষদের ৩১০টির (মহিলা আসনসহ) মধ্যে ২৯৮টি (মহিলা আসন সহ) আসন পেয়ে নিরডুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনি এ ফলাফলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করে।

২. আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি: নির্বাচনি ফলাফল অনুযায়ী ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে গড়িমশি করতে থাকে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়া ন্যায়সংগত হলেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে অহেতুক বিলম্ব করে।

৩. ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিব ব্যর্থ আলোচনা: নির্বাচনি ফলাফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হতাশ হয়ে পড়ে। ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে। অন্যদিকে ভুট্টো চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগকে পাস কাটিয়ে সরকার গঠন করতে। অপরদিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ক্ষমতার বৈধ দাবিদার। ত্রিমুখী অবস্থানে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে। এরূপ পরিস্থিতি ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিবের রাজনৈতিক সমঝোতার আলোচনা ব্যর্থ হয়।

৪. ছাত্র ও শ্রমিকদের কর্মসূচি: জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ, শ্রমিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী তথা সাধারণ মানুষ বিক্ষোপে ফেটে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় জনতা পাক সেনাদের আক্রমণ করে। সংঘর্ষে বহু লোক নিহত ও আহত হয়। যা অসহযোগ আন্দোলনকে তীব্র গতিশীল করে।

৫. স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ: ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে আ.স.ম. আব্দুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন এ চার নেতা মিলে এক বৈঠকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এ ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে পরদিন দেশব্যাপী ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং পরিস্থিতি জটিল রূপ নেয়।

৬. দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালন: ৩ মার্চ জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ মার্চ ও ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন অর্ধবেলা হরতাল পালনের ঘোষণা দেন। এ দু’দিন, সারা দেশের শ্রমিক, জনতা, ছাত্র সমাজ, কর্মকর্তা-কর্মচারী সক্রিয়ভাবে হরতাল পালন করে। ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পীরা অনুষ্ঠান বর্জন করেন এবং ছাত্র শিক্ষক, আইনজীবীরা স্ব-স্ব কর্মস্থল ত্যাগ করেন, হরতালে আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার জন্য জনসভার আয়োজন করা হয়।

৭. ৭ মার্চের ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলন: ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঙালি সৈন্য ও সাধারণ মানুষকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। বস্তুত এটি ছিল বাঙালি সৈন্যদের প্রতি ‘গ্রিন সিগন্যাল’ স্বরূপ। তাছাড়া এ বক্তৃতায় বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে সারাদেশে অসহযোগ ও প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়।

৮. অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপ্তি: ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে অসহযোগ আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সমগ্র বাঙালিরা সাড়া দেয় এবং স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। জেনারেল টিক্কা খান সামরিক আদেশ জারি করে সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও’ অসহযোগ অব্যাহত থাকে।

৯. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩৫ দফা জারি : অসহযোগ আন্দোলন বেগবান করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ মার্চ ৩৫ দফা ভিত্তিক এক নির্দেশনামা জারি করেন। এ ঘোষণায় বলা হয়-

ক. সকল সরকারি বিভাগ, সচিবালয়, হাইকোর্ট, আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহ পূর্বের মতোই বন্ধ থাকবে।

খ. বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

গ. জেলা প্রশাসক ও মহকুমা প্রশাসকরা অফিস না খুলে আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম পরিষদের সহযোগিতায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন।

ঘ. পুলিশ বিভাগও অনুরূপভাবে কাজ পরিচালনা করবেন।

ঙ. রেডিও টেলিভিশন, সংবাদপত্র চালু থাকবে। তবে গণ আন্দোলনের খবর প্রচার না করলে কর্মীরা সহযোগিতা করবে না।

চ. কর, খাজনা দেওয়া বন্ধ থাকবে।

ছ. তবে কোনো কর আদায়যোগ্য বা আদায়কৃত থাকলে তা বাংলাদেশ সরকারের একাউন্টে জমা হবে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনার পিছনে মূল দায়িত্ব পালন করেছে। নির্বাচনোত্তর ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি প্রতারণা ও নির্বিচারে বাঙালি হত্যার প্রতিবাদে বাঙালি জাতি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যে দুর্বার অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা ও মুক্তি যুদ্ধে রূপ লাভ করে। অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিল।