বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা সম্পর্কে লেখ।

অথবা, বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কর্মতৎপরতা ব্যাখ্যা কর।

উত্তর। ভূমিকা: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত বাঙালির প্রতি গণহত্যা সম্পর্কে অবহিতকরণ ও বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সরকার হিসেবে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বে

মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। নিচে বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. দূত প্রেরণ: মুজিবনগর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সমর্থন ও জনমত আদায়ের চেষ্টা করে। এছাড়াও বাংলাদেশের নাগরিক এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান ও অন্যান্য কতিপয় প্রভাবশালী দেশের সমর্থন লাভে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালানো হয়।

২. বিভিন্ন দেশে মিশন স্থাপন: বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহোমসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপন করা হয়। এছাড়া ঐসব দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি নিয়োগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয়।

৩. যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ দূত প্রেরণ: ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান সরকারের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তার তৎপরতার ফলে জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেন। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে দাতাগোষ্ঠী পাকিস্তানকে নতুন সাহায্য দানে বিরত থাকে এবং ঋণ দিতেও আপত্তি জানায়। ২ অক্টোবর ওয়াশিংটনে দাতাগোষ্ঠীর সভা বসে। এবার পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান স্থগিত করা হয়।

৪. জাতিসংঘে প্রতিনিধিদল প্রেরণ: ১৯৭১ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগর সরকারের ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। ১৬ অক্টোবর থেকে ২০ অক্টোবর তারা ওয়াশিংটন সিনেটের কেনেডি, পার্সি ও কংগ্রেসম্যান গালাকারসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৪৭টি দেশের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তবে এসব বক্তব্যে গণহত্যা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার তেমন কোনো মুখ্য বিষয় বলে বিবেচিত হয়নি বরং রাজনৈতিক সমাধানের আবেদনই ছিল মুখ্য। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি সহৃদয়তার সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীদের বক্তব্য শোনেন এবং তাদের সরকারকে তা জানাবেন বলে আশ্বাস দেন।

বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার গুরুত্ব: বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে তৎপরতা চালিয়েছিল তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ তৎপরতার ফলে বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির প্রতি বিশ্ববাসীর মধ্যে যে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতারই ফল। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন, প্রতিনিধি প্রেরণ, কূটনৈতিক তৎপরতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বহির্বিশ্বের সমর্থন লাভের চেষ্টা, বিদেশে তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়। বহির্বিশ্বে এসব তৎপরতার ফলে বিশ্ববাসী এটা বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা যা শরণার্থী সমস্যা নয়, বরং এটা ছিল শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়। তাদের তৎপরতার ফলে বিশ্ববাসী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিকভাবে অবহিত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের সাহায্যের জন্য নিপীড়ন, অবহেলিত, লাঞ্ছিত বাঙালির পাশে দাঁড়ায়। তারা তাদের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাতে তাদের সরকার বাংলাদেশকে সাহায্য ও স্বীকৃত দেয়। মূলত বাংলাদেশ ও বাঙালির সংগ্রাম বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ন ও আবেদন সৃষ্টি করেছিল তা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতারই ফল।