অথবা, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার চিত্র তুলে ধর।
উত্তরঃ ভূমিকা: মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিদের কাছে যেমন অহংকারের তেমনি বেদনার। মহান মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা শুরু করে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ৩০ লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। এত অল্প সময়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে বিপুল পরিমাণে গণহত্যা করে তা সভ্যতার ইতিহাসে বিরল ঘটনা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য ও পঙ্গু করতে এ গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সভ্যতা বিরোধী এ গণহত্যা নির্বিচারে করতে থাকে আর এ হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে এদেশীয় আল-শামস্, আল-বদর ও শাস্তি কমিটি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় বহু গণকবর রয়েছে।
পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি
ঘটতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বাধীনতা মন্ত্রে উজ্জীবিত হতে থাকে। এমতাবস্থায় ইয়াহিয়া খান ১৪-২৫ মার্চ আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকে এবং গোপনে সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে থাকে। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ব্যর্থ হলে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং জেনারেল টিকা খানকে বাঙালি নিধনের নির্দেশ দিয়ে যান। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনা, ইপিআর, পুলিশ, আনসার একযোগে এদেশের বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শিক্ষক রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক তথা সর্বস্তরের মানুষের উপর এ নারকীয় গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে এ গণহত্যা। নিচে এ বিষয়ে বর্ণনা করা হনো:
১. ২৫ মার্চ গণহত্যা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে পরিকল্পিত গণহত্যা। রাতের অন্ধকারে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ট্যাংক, মেশিনগান, মর্টার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাক হানাদার বাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, জহুরুল হক হল। পিলখানাসহ তৎকালীন ইপিআর ব্যারাক, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া ঢাকায় কচুক্ষেত, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রায়ের বাজার, ঢাকা বিমানবন্দর, গণকটুলী, ধানমন্ডি, কলাবাগান প্রভৃতি স্থানে। ২৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত নির্বিচারে গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ করে। ২৫ মার্চ রাতে প্রায় লক্ষাধিক বাঙালিকে হত্যা করা হয়। একে অপারেশন সার্চলাইট বলা হয়।
২. গণহত্যার বিকৃতি: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত চলে এ গণহত্যা। শাস্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আল-বদর, আল-শামস্ বাহিনী গণহত্যায় সহায়তা করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যে সকল গণকবর পাওয়া গেছে তা গণহত্যার প্রমাণ বহন করে। এক জরিপে দেশে এক হাজারেরও বেশি গণকবর ও বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে।
৩. গণহত্যার উদ্দেশ্য: ১৮ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে তৈরি অপারেশন সার্চলাইট নীল নকশা অনুযায়ী শুরু হয়
পরিকল্পিত গণহত্যা। লক্ষ্যবস্তু ছিল-
ক. ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্য, পুলিশ, আনসার, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী।
খ. হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
গ. আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
ঘ. কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রগণ।
ঙ. বুদ্ধিজীবী শিক্ষক, সাংবাদিক প্রমুখ।
৪. চুকনগর গণহত্যা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচেয়ে বড় গণহত্যা ছিল চুকনগর গণহত্যা। চুকনগরে পাক
হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর নির্বিচারে গুলি করে একদিনে দশ হাজারেরও বেশি লোককে হত্যা করে। চুকনগর ছিল খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত একটি বাজার। ১৯৭১ সালে এ পথ ধরেই মানুষ বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে যেতে চেয়েছিল। যুদ্ধের সময় খুলনার বিভিন্ন স্থানে হানাদারদের সহযোগীরা সাধারণ মানুষজনের উপর নির্বিচারে অত্যাচার করতে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বেশি অত্যাচার করতে থাকে ফলে হিন্দু সম্প্রদায় ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮/১৯ মে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন চুকনগর আসতে থাকে এবং ২০ মে চুকনগর লোকারণ্য হয়ে যায়। সকাল ১০টার দিকে হানাদার বাহিনীর দুটি ট্রাক এসে হাজির হয় চুকনগরে। হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ট্রাক থেকে নেমেই তারা গুলি করতে শুরু করে এবং চুকনগর পরিণত হয় এক মৃত নগরীতে। লাশের উপর লাশ, ভদ্রা নদীতে বয় রক্তের বহর। ভদ্রা নদী হয়ে যায় লাশের নদী।
৫. বুদ্ধিজীবী গণহত্যা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আরো একটি ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে শুরু করে বুদ্ধিজীবী হত্যা। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে নিয়ে মিরপুরের রায়েরবাজারে নিয়ে হত্যা করা হয়। হাজার হাজার বুদ্ধিজীবীকে রায়েরবাজারে নিয়ে গণহত্যা চালানো হয়।
৬. বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা: গণহত্যা শিরোনামে আমরা এ বিষয়ে যে সকল তথ্য পাই তার অধিকাংশ ছিল ১৯৭২
সালের। যেমন-
এছাড়া হরিরামপুরে একটি পুকুরে ১০,০০০ নরমুণ্ডু পাওয়া গিয়েছিল। এভাবে ৩০ লক্ষ বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যায় নিহত হন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা ছিল শতাব্দীর অন্যতম বর্বর গণহত্যা। পাক হানাদার বাহিনী নির্বিচারে নিরস্ত্র পুরুষ, নারী, শিশু, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা করে, এ হত্যাকাণ্ডে ৩০ লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল। গণহত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য এবং পূর্ব বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করতে চেয়েছিল।