অথবা, মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বহির্বিশ্বে অস্থায়ী সরকারের তৎপরতা লিখ।
উত্তরঃ ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মুজিবনগর সরকার গঠন। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধ সাংগঠনিক রূপ লাভ করে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। পাকবাহিনীর গণহত্যা, শোষণ নিপীড়ন, হত্যা, ধ্বংস বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল মুজিবনগর সরকার।
মুজিবনগর সরকার: ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় এবং ১০ এপ্রিল স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র জারি করে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে, মুজিবনগর সরকার গঠনের পর এ সরকারের মন্ত্রিবর্গ, কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং বহির্বিশ্বে জনমত গঠনে তৎপরতা চালায়। নিচে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হলো:
১. বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের মিশন স্থাপন: মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন আদায়ে এবং জনমত গঠনে বিভিন্ন স্থানে মিশন স্থাপন করে। কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহোমসহ বিশ্বে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপন এবং এসব স্থানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি নিয়োগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থন আদায়ে চেষ্টা করা হয়। মুজিবনগর সরকার ভারতের দিল্লিতে ও কলকাতায় বাংলাদেশের দুটি মিশন স্থাপন করে। নয়া দিল্লিতে মিশন প্রধান ছিলেন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জনাব হোসেন আলী। এ দুটি মিশন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এছাড়া ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে মিশন স্থাপন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও নিউইয়র্ক দূতাবাসের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করে। লন্ডনে ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনস্থ বেজওয়াটার এলাকায় বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে। এ মিশন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। এছাড়া সুইডেনে বাংলাদেশের মিশন স্থাপন করা হয়। মুজিবনগর সরকার মিশন স্থাপন করে বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে সক্ষম হয়।
২. কূটনৈতিক সমর্থন লাভে তৎপরতা: মুজিবনগর সরকার গঠনের পর এ সরকার জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুজিবনগর সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত নিয়োগ করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বহির্বিশ্বে সমর্থন ও জনমত আদায়ের চেষ্টা করেন। এর ফলে বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনুকূল সংবাদ শিরোনাম প্রকাশিত হয়। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণ, বিদ্যমান পরিস্থিতি ও সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক ও স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করে। মুজিবনগর সরকার কূটনৈতিক সমর্থন লাভে যে তৎপরতা চালায় তা বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছিল।
৩. বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন লাভের চেষ্টা: মুজিবনগর সরকার বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন। রেহমান সোবহান সরকারের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে যান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধি। জাতিসংঘে প্রতিনিধিদল পাঠানো এবং বিশ্বব্যাংকে প্রতিনিধি পাঠানোর ফলে দাতাগোষ্ঠী পাকিস্তানকে নতুন সাহায্য দানে বিরত থাকে এবং ঋণ রেয়াতি দিতেও আপত্তি জানায়। ২ অক্টোবর ওয়াশিংটনে দাতাগোষ্ঠীর সভা বসে। এখানে পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদান স্থগিত করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান, অবিলম্বে এবং বিনা শর্তে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দান, ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে অবিলম্বে অপসারণ করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচার প্রচারণা চালায়।
৪. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তহবিল সংগ্রহ: মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে তহবিল সংগ্রহ করা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা। ১৯৭১ সালের ৮ মে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অ্যাকশন কিমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের জরুরি মিটিং ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বাংলাদেশ ফান্ড নামে একটি তহবিল গঠন করা হয়। এ ফান্ড ৩,৭৬,৫৬৮ পাউন্ড পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগ্রহ করে যা সরাসরি বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছিল। এছাড়া অন্যান্য দেশ থেকে যে অর্থ সংগৃহীত হয় তা নিচে বর্ণনা করা হলো।
বাহরাইনে বাংলাদেশ ক্লাব হতে ১,৪৯,৭৫৭ পাউন্ড, কাতারে বাংলাদেশে শিক্ষা কেন্দ্র হতে ৩,১০,০২৯ পাউন্ড লিবিয়ার বাংলাদেশ শিক্ষা কেন্দ্র থেকে ২,৩৮,২৪২ পাউন্ড অর্থ সংগৃহীত হয়।
শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজের জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারত সরকার বিভিন্ন দেশ হতে কিছু অর্থ সাহায্য গ্রহণ করেছিল। জাতিসংঘের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ যে পরিমাণ অর্থ সাহায্য করেছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
= ৮,৯১,৫৭,০০০ ডলার
যুক্তরাজ্য
= ৩,৮১,১২,১৩২ ডলার
কানাডা
= ২,০২,৬০,৩০৭ ডলার
সোভিয়েত ইউনিয়ন
২,০০,০০,০০০ ডলার
সুতরাং মুজিবনগর সরকার বহির্বিশ্বে তৎপরতা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়।
বহির্বিশ্বে তৎপরতার প্রতিক্রিয়া: মুজিবনগর সরকার বহির্বিশ্বে যে তৎপরতা চালায় তার ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায়। মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার ফলে বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সহানুভূতি সৃষ্টি হয় এবং সমর্থন আদায়ে জোর প্রচারণা চালানো হয়। মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার কারণে প্রবাসী বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং এর জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ সাফল্য অর্জন করে। মুজিবনগর সরকারের প্রচারণা ও তৎপরতায় যে জনমত গঠিত হয় তার ফলে পাক শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও জাতিসংঘের মহাসচিব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণরক্ষার আবেদন জানিয়েছিল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ও তৎপরতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুজিবনগর সরকারের জন্য প্রচারণা ও সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠিত হয়। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ একটি সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ন ও আবেদন সৃষ্টি করেছিল তা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতারই ফল।