১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য উল্লেখ কর।

অথবা, মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভূমিকা মূল্যায়ন কর।

অথবা, মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুজিবনগর সরকারের স্বীকৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধকে আইনগত ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভিত্তি পায় এবং বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং মুক্তিযুদ্ধ এ সরকারের নেতৃত্বেই পরিচলিত হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের গুরুত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অপরিসীম ও অপরিহার্য ছিল।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র : দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও স্থানীয় বিপুলসংখ্যক জনগণের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী (এম এন এ) এটি পাঠ করেন। এটিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক ঘোষণা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঘোষণায় বলা হয়-

“সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন, সে মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য, বিবেচনা আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি। আমাদের স্বাধীনতার এ ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে।”

মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য বা গুরুত্ব : নিচে স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য বা গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:

মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য যা গুরুত্ব: নিচে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য বা
গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:

১. স্বাধীনতা ঘোষণার স্বীকৃতি প্রদান: মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচন নিয়ে পাকিস্তানে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পূর্বে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর প্রতি তিনি একটি ঘোষণা দিয়েছেন। ২৬ মার্চের এ ঘোষণায় তিনি বলেন, “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে দখলদার বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি।” ১০ এপ্রিল প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে এ ঘোষণাপত্র ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

২. কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার উৎস: স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার উৎস প্রাপ্ত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে মৌলিক আইনের ভিত্তি ছিল এ স্বাধীনতার সনদ। এর মাধ্যমে মুজিবনগর প্রশাসনের কর্মকাণ্ডের বৈধকরণ করা হয়। এ সনদ ছিল আইনের মূল সূতিকাগার এবং সরকারের সমস্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার উৎস।

৩. যুদ্ধের যৌক্তিক ভিত্তি প্রদান: স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিক ভিত্তি প্রদান করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর যে গণহত্যা, নির্যাতন ও দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল তার থেকে বাঙালিদের মুক্তি, সম্মান ও সংহতি রক্ষার জন্য এ যুদ্ধ ছিল যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত।

৪. অস্থায়ী সংবিধান: বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছিল অস্থায়ী সংবিধান। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এটি ছিল দেশের সংবিধান। সরকার ব্যবস্থা, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সকল কার্যনির্বাহী ও আইন সম্বন্ধীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদে কর আরোপ, সাংবিধানিক সংসদ আহ্বান ও স্থগিতসহ নানাবিধ ক্ষমতা প্রদান করা হয় রাষ্ট্রপতিকে।

৫. অস্থায়ী সরকার: স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী প্রবাসী সরকারের নাম হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। দীর্ঘ ৯ মাস এ সরকার মুজিবনগর সরকার নামেই পরিচিতি লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান, শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা করা, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, বহির্বিশ্বে জনমত গঠন ছিল এ অস্থায়ী সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি।

৬. যুদ্ধকে সাংগঠনিক রূপ প্রদান: স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ সাংগঠনিক রূপ পায়। জনগণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধ শুরু করে। জনগণের মধ্যে কোনো সংগঠন না থাকায় লক্ষ্য নিয়ে সংশয় ছিল। ফলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধ একটি সংগঠনিক রূপ লাভ করে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে অগ্রসর হতে থাকে।

৭. সিভিল প্রশাসনের শৃঙ্খলা রক্ষা: স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সরকারের সিভিল প্রশাসন ও সামরিক
প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড নিশ্চিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করা এবং এ যুদ্ধকে আইনগত ভিত্তি দেওয়ার জন্য এটি প্রয়োজন ছিল।

৮. বঙ্গবন্ধুকে মূল নেতৃত্বে রেখে যুদ্ধ পরিচালনা: বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সমার্থক ছিল। বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বের
কারণে জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি ছিল অটুট। মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ধরে রাখা এবং জনসমর্থন ধরে রাখতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৯. বিশ্ব জনমত সৃষ্টি: স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধের যৌক্তিকতা ও ন্যায়সংগত অধিকার রক্ষা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সনদে জাতিসংঘের সকল দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় এবং এভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন প্রত্যাশা করা হয়।

১০. বাংলাদেশের অভ্যুদয়: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর দেশ পরিচালনার জন্য আইনসমূহের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে এ সনদ অব্যাহতভাবে কার্যকর থাকে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল অবিসংবাদিত।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অপরিহার্য। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারির মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ তার যৌক্তিকতা ও ন্যায়সংগত অধিকার বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা হয়। মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে যুদ্ধকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দিকনির্দেশনা প্রদান করে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।