অথবা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আবির্ভাবের ক্ষেত্রে কী কী কারণ দায়ী ছিল? বর্ণনা কর।
অথবা, কী কী কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়? আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশ আবির্ভাবের কারণগুলো কী কী? আলোচনা কর।
অথবা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কারণগুলো আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শাসন পরিচালনার কথা থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান সর্বদা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি বৈষম্যের স্বীকার হয় এবং ন্যায়সংগত দাবিদাওয়া থেকে সকল সময় বঞ্চিত হয়। শোষণ ও অবহেলার প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। পূর্ব বাংলার মানুষ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলন গড়ে তোলে। আর এ আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয় ১৯৭১ সালে এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে।
বাংলাদেশের আবির্ভাবের কারণ: নিচে বাংলাদেশের আবির্ভাবের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. রাজনৈতিক কারণ: ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হয়। মূল লাহোর প্রস্তাবে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা থাকলেও ১৯৪৬ সালে দিল্লি বৈঠকে ‘States’ এর পরিবর্তে ‘State’ করা হয়। মূলত তখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে থাকেন। এছাড়া ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। ১৯৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরেও তারা মেনে নেয়নি। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিষিয়ে উঠে এবং ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে।
২. অর্থনৈতিক কারণ: পশ্চিমা শাসন ও শোষণের ফলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়।
যেমন-
১৯৬৪-৬৫ সালে যেখানে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য ছিল ৪৬%, সেখানে ১৯৬৫-৭০ সালে এসে দাঁড়ায় ৬০%। সম্পদ পাচার ও বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রেও অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। এক হিসাব অনুযায়ী ১৯৪৮-৬৯ সালের মধ্যে
মোট ৪১৯ কোটি টাকার সম্পদ পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করা হয়। আবার ১৯৫০-৬৯ সালের মধ্যে পাকিস্তান যে ৫,৬৮৩ ডলার সাহায্য লাভ করে তার মধ্যে ৩৪% পূর্ব পাকিস্তানকে দেওয়া হয়। এসব কারণে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৩. সাংস্কৃতিক সংঘাত: পাকিস্তানের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর Two Nation Theory’ এর আলোকে পাকিস্তান ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও পাকিস্তানের অধীনে যে দুটি ভিন্ন স্বাতন্ত্র্যসম্পন্ন জাতির অবস্থান ছিল তা দিবালোকের ন্যায় সত্য। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ছিল বাঙালি এবং বাংলা ছিল তাদের মাতৃভাষা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিয় সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তারা জোরপূর্বক বাঙালিদের উপর উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।
৪. সামাজিক কারণ: অদ্ভুত ভৌগোলিক অবস্থানহেতু এর দুটি অংশের সামাজিক কাঠামো পরস্পরবিরোধী উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। ফলে একই দেশের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও দুই দেশের জনগণের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার, জীবনযাত্রা, পেশা, শিল্প, আচারব্যবহার এককথায় সামাজিক জীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নিজস্ব আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। ফলে রাষ্ট্রীয় জীবনকে সুসংহত করার জন্য কোনো একক সামাজিক আদর্শ পাকিস্ত ানে গড়ে উঠতে পারেন। এটা বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের একটি অন্যতম কারণ ছিল।
৫. মনস্তাত্ত্বিক কারণ: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে মনের দিক দিয়ে কোনোদিনই মিল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানেরা নিজেদের খাঁটি মুসলমান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের হিন্দু সম্প্রদায় মনে করত। পূর্ব বাংলার মানুষ মুসলিম জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানে যোগদান করলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা, সাহিত্য, জীবনযাত্রা প্রভৃতি বিষয়ে সমস্যা বোধ করতে থাকে এবং নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে।
৬. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে: পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার প্রথম দিক থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণ বেশি সুযোগ লাভকরে আসছিল। এর ফলে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোতে পূর্ব পাকিস্তানের অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভূত হয়। ১৯৫৮ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা ছিল ১৯ জন সচিবের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে একজনও না। ৪১ জন যুগ্ম সচিবের মধ্যে ৩ জন এবং উপসচিবদের ৩৩ জনের মধ্যে ১০ জন ছিল বাঙালি।
৭. ভৌগোলিক কারণ: ভৌগোলিক অখণ্ডতা রাষ্ট্র গঠনের একটি অন্যতম কারণ। ভৌগোলিকভাবে সংলগ্ন বা অখণ্ড না হলে কোনো রাষ্ট্রেরই অস্তিত্ব বেশি দিন টিকে থাকে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। ১৯৪৭সালে পাকিস্তানের প্রদেশ হিসেবে যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল তা মূলত পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশ হতে প্রায় ১২০০ মাইলেরও বেশি ব্যবধানে অবস্থিত ছিল। এরূপ ভৌগোলিক অসংলগ্ন দুটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রের জন্য যে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানি শাসকদের নিকট তা কখনো অনুমিত হয়নি। তাই সর্বদা এলাকা দুটি পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আর কালক্রমে তা হয়েছেও।
৮. শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য : পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বৈষম্য দেখা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানে যাবতীয় প্রাথমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে থাকলে পূর্ব পাকিস্তানিরা ক্ষুব্ধ হতে থাকে। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তানিদের শিক্ষার ব্যাপারে প্রচুর উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। পক্ষপাতমূলক উন্নয়ন, কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক ব্যয় ও বেসামরিক ব্যয়, সামরিক ক্ষেত্রে বৈষম্য, বেসামরিক চাকরির বৈষম্য এবং নানাবিধ সামাজিক কারণে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে।
৯. রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন : বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল অন্যতম। বস্তুত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত গঠিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই বাঙালিদের ভাষা, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে না বাংলা হবে- এ নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত বাঙালিরা ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
১০. শিল্পক্ষেত্রে বৈষম্য: পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব উভয় অংশে শিল্প প্রতিষ্ঠায় বৈষম্যমূলক নীতির ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পায়। পূর্ব পাকিস্তানে তেমন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠায় এ অঞ্চলের শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন ছিল কম। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় সেখানে শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
১১. ‘৭০ সালের নির্বাচন: ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকরে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সমস্ত পাকিস্তানের নিরডুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
১২. কৃষিক্ষেত্রে বৈষম্য: কৃষি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে মূলত ধান, পাট, চা উৎপাদিত হয় এবং এর উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক কাঠামো দৃঢ়তা লাভ করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের উৎপন্ন দ্রব্য রপ্তানি দ্বারা পাকিস্তানের বৈদেশিক আয়ের ৫০/৭০ ভাগ অর্জিত হতো। অথচ বৈদেশিক আমদানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ২৫/৩০ ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় যে, বাংলাদেশের আবির্ভাব ছিল অত্যন্ত বাস্তব। একদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ অন্যদিকে, বাঙালিদের ইস্পাত কঠিন আন্দোলন পাকিস্ত ানের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে।