১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল? আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কী কারণে এ উপমহাদেশের ইতিহাসে এক মাইলফলক? আলোচনা কর।

অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে প্রভাবিত করেছিল? আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী S. M. Lipset বলেছেন, “The way that a nation is born conditions much of its later political developments.” বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাজনীতির প্রেক্ষাপটে লিপসেটের এ উক্তির যথার্থ প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। ইতালি এবং জার্মানির বিপ্লবোত্তর রাজনীতির কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৭১ সালের এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রাম করে এবং ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের এ রক্তক্ষয়, সশস্ত্র জনযুদ্ধের এ প্রকৃতি ও ত্যাগ তিতিক্ষা

বাংলাদেশের স্বাধীনোত্তর রাজনীতিতে এক ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের রাজনীতির উপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব: নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. সামাজিক ক্ষেত্রে: বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাধীনোত্তর নতুন নতুন অসংখ্য সংকট ও সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পুনর্বাসন সমস্যা অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করে। কেননা স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিটি পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্যাতনের স্বীকার হয়। প্রায় ১ কোটি লোক ছিন্নমূল হয়ে পড়ে। ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী বাঙালি, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও লাঞ্ছিত মহিলাদের নিয়ে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়।

২. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে: মুক্তিযুদ্ধের ফলে দেশের প্রশাসনিক অবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। দেশ শাসনের ন্যূনতম উপাদানগুলো পর্যন্ত ছিল না। Civil service, জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ছিল অপর্যাপ্ত এবং অবিন্যস্ত।

৩. অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে: স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের অর্থনীতি-ছিল খুবই বিপর্যস্ত। পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল অবিন্যস্ত। কলকারখানায় উৎপাদন সামগ্রী এবং যন্ত্রপাতি ছিল বিকল। নদীপথে এবং সামুদ্রিক বন্দরগুলো ছিল অকেজো। ফলে দেশের উৎপাদন দারুণভাবে হ্রাস পায়।

৪. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে যায়। ছাত্রলীগের যে অংশটি মূল সংগঠন থেকে বের হয়ে আসে তার নেতৃত্বে থাকেন আ.স.ম. আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজ। এভাবে বহু রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয় এবং সরকারের বিরোধিতা শুরু করে।

৫. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন: স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সামরিক বাহিনীর মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ করা যায় তা হলো পাকিস্তান শাসন আমল থেকে সেনাবাহিনীর অফিসারদেরকে যেসব সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছিল তা বাতিল করে একটি সংঘবদ্ধ বাহিনী গড়ে তোলার দাবি। ‘৭১ সালে বামপন্থি বিশেষ করে চীনপন্থিদের সংস্পর্শে যেসব সেনাবাহিনীর জওয়ান এবং অফিসারগণ আসেন, তাদের মধ্যে এ দাবি উত্থাপিত হয়। সামরিক বাহিনীকে উৎপাদনমুখী করে গড়ে তোলাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের গোপন সংস্থা বিপ্লবী গণবাহিনীর প্রধান কর্নেল তাহের ছিল অন্যতম। তাদের উদ্যোগে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গড়ে তোলা হয়।

৬. সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে : সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা স্বাধীনোত্তরকালে বেশ প্রকট আকার ধারণ করে। তা হলো ঔপনিবেশিক আমল থেকে সেনাবাহিনীর অফিসারদেকে যেসব বিশেষ সুযোগ ও সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তা বাতিল করে একটি সুসংবদ্ধ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার দাবি। ১৯৭১ সালে যেসব সামরিক অফিসার ও জোয়ান বামপন্থিদের বিশেষ করে চীনপন্থিদের সংস্পর্শে আসে, তাদের মাধ্যমেই এ দাবি উঠে। তাদের বক্তব্য ছিল সামরিক বাহিনীকে উৎপাদনমুখী করে গড়ে তোলা। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের গোপন সংস্থা বিপ্লবী গণবাহিনীর প্রধান কর্নেল তাহের ছিল তাদের অন্যতম।

৭. আমলাতন্ত্রের উপর: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব স্বাধীনোত্তরকালে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরও অধিক মাত্রায় এসে পড়ে। আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে মুজিবনগর ফেরত বনাম পাকিস্তান সরকারের অধীনে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভক্ত ও স্বাতন্ত্র্যবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশে ফিরে আসার পর এ বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে।

৮. মেরুকরণ প্রক্রিয়া: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে অথবা যেসব জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল কিংবা যারা স্বাধীনোত্তরকালে পাকিস্তান থেকে পুনর্বাসিত হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। মস্কোপন্থি দলগুলো আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন যুগিয়ে যায়। পক্ষান্তরে, পিকিংপস্থি দলগুলো যারা অসমাপ্ত বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিল, তারা সরকারের বিরোধিতা করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে আমরা বলতে পারি যে, একাত্তরের স্বাধীনতা বিপ্লব স্বাধীনোত্তরকালে বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন গতি প্রদান করেছে। নতুন নতুন ইস্যু যোগ হয়ে সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন জাতীয় প্রশ্নে ঐক্য মনোভাব আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি ক্ষেত্রে এটা প্রভাবিত হয়েছে। এ সময় হতে এক নতুন ধারায় আবর্তিত হতে শুরু করে বাংলাদেশের রাজনীতি। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে আজ অবধি বাংলাদেশে অব্যাহত রয়েছে।